আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের খুব ভালোবাসেন। তাঁর ইচ্ছায় আমরা সুন্দর জীবন গড়ে তুলব। দুনিয়াতে সুখ-শান্তি পাব। আখিরাতে জান্নাত লাভ করব। জান্নাতে রয়েছে চরম শান্তি ও পরম আনন্দ।
কীভাবে আমরা সুন্দর জীবন গড়ে তুলব। কোন পথে চললে আল্লাহ খুশি হবেন? কী কাজ করলে দুনিয়াতে সুখে বসবাস করব ও শান্তিতে থাকব? এসবের সন্ধান পেয়েছি আমরা নবি-রাসুলের মাধ্যমে। নবি-রাসুল আমাদের শিক্ষক। তাঁরা আমাদের আল্লাহর ইবাদত করার নিয়মকানুন শিখিয়েছেন। সঠিক পথে জীবনযাপন করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা অনেক নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন। কুরআন মজিদে ২৫ জন নবি-রাসুলের নাম উল্লেখ আছে। এদের মধ্যে হযরত আদম আলাইহিস সালাম পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানুষ এবং প্রথম নবি। আর আমাদের মহানবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। এখন আমরা কয়েকজন নবি-রাসুলের জীবনাদর্শ জানব।
জন্ম ও পরিচয়
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বার নাম আব্দুল্লাহ। আম্মার নাম আমিনা। তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মদ (প্রশংসিত)। আর আম্মা আমিনা তাঁর নাম রাখেন আহমাদ (প্রশংসাকারী)।
মহানবি(স) এর জন্মের আগেই তাঁর আব্বা ইন্তিকাল করেন। আর তাঁর ছয় বছর বয়সে আম্মা ইন্তিকাল করেন। বাবা-মা হারা ইয়াতীম শিশুকে তখন থেকে লালন-পালন করতে থাকেন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব। দাদার ইন্তিকালের পর তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মহানবি (স)-কে খুব আদর-স্নেহ করতেন।
তাঁর চরিত্র ছিল খুবই সুন্দর। শিশুকাল থেকেই তিনি সব সময় সত্য কথা বলতেন। মানুষের উপকার করতেন। বড়দের সম্মান করতেন। ছোটদের আদর করতেন। কখনো মিথ্যা কথা বলতেন না। কাউকে গালি দিতেন না। কারও সাথে ঝগড়া করতেন না। মারামারি করতেন না। হিংসা করতেন না। সকলের সাথে মিলেমিশে থাকতেন।
সবাই তাঁকে ভালোবাসত। আদর করত। সম্মান করত । বিশ্বাস করত। আল-আমিন বলে ডাকত। আল-আমিন অর্থ বিশ্বাসী। মহানবি (স) এর মতো আমরা
সত্যকথা বলব, মানুষের উপকার করব,
বড়দের সম্মান করব, ছোটদের আদর করব,
সকলকে ভালোবাসব, বিশ্বাস করব,
তাহলে মহানবি (স) আমাদের ভালোবাসবেন, আল্লাহ ভালোবাসবেন
হিলফুল ফুজুল গঠন
মহানবি (স) ছোটবেলা থেকেই অপরের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। শিশু অবস্থায়ই তিনি অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর দুধমা হালিমার একটি পুত্র সন্তান ছিল। তিনি তাঁর দুধমার একটি স্তনের দুধ নিজে পান করতেন এবং অন্য স্তনের দুধ তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অপরের দুঃখে দুঃখ পেতেন। অন্যের কষ্টে কষ্ট পেতেন, অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হতেন ৷
তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। কারও কোনো অসুবিধা হলে তা দূর করার চেষ্টা করতেন। অসহায় ও নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করতেন। সাধ্যমতো মানুষের সেবা করতেন।
জুয়াখেলা মারাত্মক অপরাধ। এতে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়। শত্রুতা বাড়ে। অনেক কলহ ও মারামারি হয়। যুদ্ধবিগ্রহ ঘটে। একদা আরবদেশে ওকায মেলায় জুয়াখেলাকে কেন্দ্র করে কুরাইশ ও কায়েস বংশের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ দীর্ঘ পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। অনেক লোক এ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। মহানবি (স) নিজে তাঁর চাচা যুবায়ের (রা)-এর সাথে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীরগুলো সংগ্রহ করে
চাচার হাতে তুলে দিতেন। এটি ‘হারবুল ফিজার' বা ‘অন্যায় সমর’ নামে পরিচিত। এ ভয়াবহ যুদ্ধের দৃশ্য দেখে মহানবি (স)-এর প্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি চিন্তা করলেন, কীভাবে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়? কীভাবে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যায়? অসহায়দের সাহায্য করা যায়? এজন্য তিনি কয়েকজন উৎসাহী যুবককে সাথে নিয়ে একটি সেবাসংঘ গঠন করেন। আর এই সংঘের নাম রাখেন হিলফুল ফুজুল বা শান্তিসংঘ। এই সংঘের মাধ্যমে তিনি দুঃখী ও অসহায়
মানুষদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেন। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। তখন মহানবি (স) এর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। এ সংঘ প্রায় ৫০ বছর স্থায়ী ছিল।
পরিকল্পিত কাজ: শিক্ষার্থীরা ‘হিলফুল ফুজুল' –এর নীতিগুলো খাতায় লিখবে। |
নবুয়ত লাভ
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) সমাজের দুরাবস্থা দেখে দুঃখ পেতেন। কষ্ট পেতেন। মানুষের নৈতিক অধঃপতন তাঁকে বিশেষভাবে চিন্তিত করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর চিন্তাভাবনাও বাড়তে থাকে। তিনি মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে ‘হেরা” নামক পর্বতের নির্জন গুহায় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মনে নানা চিন্তা ও প্রশ্ন জাগত ৷
তিনি ভাবতেন আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? কেন এসেছি? আবার কোথায় যাব?
এই পৃথিবী সৃষ্টির কী উদ্দেশ্য? মানুষ এত মারামারি, কাটাকাটি কেন করে ইত্যাদি।
এভাবে মহানবি (স)-এর ধ্যান ও ইবাদত চলতে থাকল। তাঁর বয়স ৪০ বছর হলো। রমযান মাসের কদর রাত। মহানবি (স) হেরাগুহায় ধ্যানরত। চারদিক নীরব, নিঝুম। এমন সময় আঁধার গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাইল (আ) আল্লাহর মহান বাণী সর্বপ্রথম নিয়ে আসলেন। তিনি মহানবি (স)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ) (ইক্বরা-পড়ুন)। পড়তে বললেন, কুরআন মজিদের সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত ।
সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতের অর্থ:
ক) (হে মুহাম্মদ!) পাঠ করুন, আপনার সেই প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।
খ) যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত (আলাক) থেকে।
গ) পাঠ করুন আপনার সেই মহিমান্বিত প্রতিপালকের,
ঘ) যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে।
ঙ) শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না ৷
এভাবে তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করলেন।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াতের অর্থ খাতায় লিখবে। |
মক্কায় ইসলাম প্রচার
মহানবি (স) নবুয়ত লাভের পর আল্লাহর তাওহিদ (একত্ববাদ) প্রচার করতে থাকলেন। তাওহিদ অর্থ একত্ববাদ। তিনি প্রথম তিন বছর আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম লোকদের কাছে গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা) এবং বালকদের মধ্যে হযরত আলী (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম তিন বছরে ৪৫ জন নরনারী ইসলাম গ্রহণ করেন
অতঃপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতে থাকলেন। কিন্তু কুরাইশ বংশের অনেক নেতা তাঁর কথা মানল না। তারা মহানবি (স)-এর ঘোর শত্রু হলো। মহানবি (স)-এর উপর রেগে গেল। তাঁর উপর অত্যাচার শুরু করল। তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মারল। রক্তাক্ত করল।
কেউ কেউ তাঁকে পাগল বলতে লাগল। তাঁর উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হলো। তাঁর মাথার উপর ময়লা-আবর্জনা রাখল। চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিল। তাঁর অনুসারীদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করল। এভাবে তারা মহানবি (স) ও তাঁর অনুসারীদেরকে ইসলাম প্রচারে বাধা দিতে থাকল।
মহানবির (স) আল্লাহর উপর অটল বিশ্বাস ছিল। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি সব অত্যাচার সহ্য করলেন। সকল বাধা অতিক্রম করে তিনি ইসলাম প্রচার করলেন।
পরিকল্পিত কাজ : মক্কায় ইসলাম প্রচারে মহানবি (স) যেসব বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা তার একটি তালিকা তৈরি করবে। |
শ্রমের মর্যাদা দান
শ্রম মানে কাজ করা, পরিশ্রম করা। আমাদের মহানবি (স) সবসময় নিজের কাজ নিজেই করতেন। তিনি কখনো কাজ ফেলে রাখতেন না। কাজে অবহেলা করতেন না। নিজে কাজ করতেন। অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।
আমরা অনেক সময় কাজ করতে গেলে লজ্জা পাই। মনে করি যে, কাজ করলে লোকে আমাকে কাজের লোক বলবে। চাকর বলবে। ঘৃণা করবে। অসম্মান করবে। কিন্তু এ রকম মনে করা ঠিক না। বরং কাজ করলে সকলে তাকে ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। স্নেহ করে। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। মর্যাদা দান করেন।
মহানবি (স) ছেঁড়া জামাকাপড় নিজ হাতে সেলাই করতেন। জুতা মেরামত করতেন। জামা-কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করতেন। ঘর ঝাড়ু দিতেন। মেহমানকে নিজে খাওয়াতেন। সেবাযত্ন করতেন। তিনি পরিবারের অন্যদের সাথে কাজ করতেন। সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করতেন। কাজকে ঘৃণা করতেন না।
একটি ঘটনা: একদিন মহানবি (স) রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। দেখতে পেলেন যে, এক বৃদ্ধ লোক বাগানে পানি দিচ্ছে। পানি ছিল বাগান থেকে অনেক দূরে। বৃদ্ধ লোকটির পানি আনতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। লোকটি ছিল চাকর। মহানবির (স) দয়া হলো। তিনি লোকটির কষ্ট দেখে এগিয়ে গেলেন। বৃদ্ধের হাত থেকে পানির পাত্রটা নিজের হাতে নিয়ে বাগানে পানি দিলেন। বৃদ্ধ লোকটি মহানবির (স) উপর খুব খুশি হলেন ।
মহানবি (স) চাকরদের সম্পর্কে বলেছেন, “যারা কাজ করে তারা তোমাদের ভাই। তাদের কষ্ট দেবে না। মর্যাদা দেবে। নিজে যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে। নিজে যা পরবে তাদের তা পরাবে। কাজকর্মে তাদের সাহায্য করবে।”
তিনি আরও বলেন, “শ্রমিককে তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”
আমাদের বাসাবাড়িতে গরিব লোকজন ও মহিলারা নানারকম কাজকর্ম করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাজকর্ম করে থাকে। আমরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করব। কাজের লোকজন বয়সে বড় হলে তাদের সম্মান করব। বয়সে ছোট হলে আদর-স্নেহ করব। নিজেরা যা খাব তাদেরও তাই খেতে দেব। মাত্রাতিরিক্ত কাজ দেব না। তাদের কাজে সাহায্য করব। তাদের কষ্ট দেব না। দুঃখ দেব না। তারা আমাদের মতো মানুষ। তারা আমাদের ভাই। আমাদের মতো তাদেরও মর্যাদা আছে। আমরা তাদের মর্যাদা দেব। তাদের শ্রমের মর্যাদা দেব।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা মহানবি (স)-এর শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে ৫টি বাক্য লিখবে। |
মহানবি (স)-এর দয়া
মহানবি (স) ছিলেন দয়ার উজ্জ্বল আদর্শ। তিনি মানুষ, পশুপাখি ও গাছপালা সকলের প্রতি দয়া প্রদর্শন করতেন। কেউ ক্ষুধার্ত হলে তাকে খাদ্য দিতেন। অসুস্থ হলে তার খোঁজখবর নিতেন। সেবাযত্ন করতেন। গরিব, ভিক্ষুক, ইয়াতীম ও অসহায়দের প্রতি দয়া দেখাতেন।
একদা মহানবি (স) সাহাবিদের নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় এক ইয়াতীম বালক মহানবির (স) কাছে আসলো। গায়ে তার জামাকাপড় নাই। দুঃখকষ্ট সইতে সইতে তার বুকের হাড়গুলো বের হয়ে গেছে। বালকটি কাঁদতে কাঁদতে মহানবিকে (স) বলল, আমার আব্বু নাই। আবু জাহল আমাদের সম্পদ কেড়ে নিয়েছে। তার কাছে সম্পদের কিছু চাইলে সে আমাকে মারধর করে, অত্যাচার করে, তাড়িয়ে দেয়। বালকটির কথা শুনে মহানবির (স) মনে দয়া হলো। তাঁর চোখে পানি এলো। তিনি বালকটিকে নিয়ে আবু জাহলের কাছে গেলেন। বালকটির সব পাওনা আবু জাহলের কাছ থেকে আদায় করে দিলেন। ইয়াতীম বালকটি খুব খুশি হলো।
তিনি শুধু মানুষের প্রতি দয়া দেখান নি, বরং আল্লাহর সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখিয়েছেন। যারা আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখায় আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। তাদের প্রতি খুশি হন।
মহানবি (স) বলেছেন, “পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া দেখাও, তাহলে আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া দেখাবেন ।”
আমরা দয়া দেখাব-
ইয়াতীম, অসহায়দের প্রতি,
পশুপাখি ও গাছপালার প্রতি,
সকল মানুষের প্রতি,
আল্লাহর সকল সৃষ্টির প্রতি ।
মহানবি (স)-এর ক্ষমা
মহানবি (স) ছিলেন ক্ষমার মূর্তপ্রতীক। তিনি শত্রু-মিত্র সবাইকে ক্ষমা করতেন। তিনি তাঁর চরম শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও প্রতিশোধ নেন নি। তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
একটি ঘটনা: মহানবি (স) গাতফানের যুদ্ধ শেষ করে বাড়িতে ফিরছেন। এক কাফির তাঁর কাছে আসলো। সে একটি খোলা তলোয়ার মহানবি (স)-কে দেখিয়ে বলল,“হে মুহাম্মদ, তোমাকে এই তলোয়ারের আঘাত থেকে কে রক্ষা করবে?” মহানবি (স) নির্ভয়ে উত্তর দিলেন, “আল্লাহ”। কাফির উত্তর শুনে খুবই ভয় পেল। তার হাত থেকে তলোয়ারটি পড়ে গেল। তখন মহানবি (স) ঐ তলোয়ারটি হাতে তুলে নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন, “ওহে, এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে?' কাফির খুব ভয় পেল। মহানবি (স)-এর নিকট ক্ষমা চাইলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন
মক্কা বিজয়ের পর মহানবি (স) সকল মক্কাবাসীকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষমার আদর্শে মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা মহানবি (স)-এর ক্ষমা সম্বন্ধে ৫টি বাক্য লিখবে। |
মহানবি (স)-এর মাতৃভক্তি
আব্বা-আম্মা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। বিশেষ করে আম্মা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেন। তিনি স্নেহ-মমতা ও দরদ দিয়ে আমাদের লালনপালন করেন। আমাদের কল্যাণ কামনা করেন। এহেন হিতাকাঙ্ক্ষী মায়ের ভক্তি করা একান্ত কর্তব্য।
মহানবির (স) বয়স যখন ৬ বছর তখন তাঁর আম্মা আমিনা ইন্তিকাল করেন। তাই তিনি তাঁর আম্মাকে সেবাযত্ন করার সুযোগ পান নি। কিন্তু তাঁর দুধমা হযরত হালিমা (রা) কে তিনি চরম ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। সম্মান দিতেন।
একদিনের ঘটনা: আমাদের মহানবি (স) সাহাবিগণের সাথে বসে আছেন। সেখানে এক বৃদ্ধা আসলেন। মহানবি (স) তাঁকে দেখে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধাকে সম্মান করলেন। মর্যাদা দিলেন। নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিলেন। খুব যত্নের সাথে বসালেন। সাহাবিগণ অবাক হলেন। তাঁরা মহানবিকে (স) জিজ্ঞাসা করলেন, “ইনি কে?” তিনি উত্তরে বললেন, “ ইনি আমার দুধমা হালিমা ।”
পরিকল্পিত কাজ: শিক্ষার্থীরা মহানবি (স)-এর মাতৃভক্তি ঘটনাটি খাতায় লিখবে । |
হযরত মূসা (আ) ছিলেন একজন বিখ্যাত নবি। তাঁর পিতার নাম ইমরান। মাতার নাম ইউখাবেজ। তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০৪০ অব্দে মিশরে বনি ইসরাইল বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচীনকালে মিশরের বাদশাহকে ফিরআউন বলা হতো। তাদের মধ্যে এক ফিরআউনের নাম ছিল ওলীদ। ওলীদ ছিল খুব লোভী। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজেকে উপাস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। সে তার মন্ত্রী ও বন্ধু হামানের পরামর্শে রাজ্যের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিল। জনগণ ধর্ম ও জ্ঞানচর্চা ভুলে মূর্খে পরিণত হলো। সুযোগ বুঝে সে নিজেকে উপাস্য বলে ঘোষণা করল। কিবতী বংশ তার অনুগত ছিল, তারা তাকে পূজা করতে শুরু করল। কিন্তু বনি ইসরাইল বংশ তখনও হযরত ইউসূফ (আ) এর একত্ববাদের ধর্ম মেনে চলত। তারা ফিরআউনকে খোদা বলতে সম্মত হলো না । ফিরআউন ও কিবতী বংশ বনি ইসরাইলদের উপর কঠিন নির্যাতন চালাতে লাগল। এরই মধ্যে ওলীদ স্বপ্নে দেখল যে, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে এক ঝলক আগুন বের হয়ে এসে তার রাজপ্রাসাদসহ গ্রাস করছে। তার অনুসারী কিবতী বংশকেও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলগণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। আগুন তাদের স্পর্শ করছে না। ফিরআউন রাজ্যের গণকদের ডেকে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইল। বালআম বাউর নামে এক গণক বলল, “ইসরাইল বংশে একটি পুত্র শিশু জন্মগ্রহণ করবে। সে আপনার ও আপনার রাজত্বের ধ্বংসের কারণ হবে এবং কিবতী বংশ ধ্বংস হবে।” স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফিরআউন তার সিংহাসন থেকে লাফিয়ে উঠল। সে রাজ্যময় সৈন্যদের পাহারা নিযুক্ত করল এবং জন্মগ্রহণকারী সকল ইসরাইলি শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ দিল। সৈন্যরা গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা তৈরি করল। আর জন্মগ্রহণকারী পুত্রসন্তানকে হত্যা করতে লাগল। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি শিশুপুত্র ফিরআউনের লোকদের হাতে নিহত হলো ।
জন্ম
হযরত মূসা (আ)-এর মাতা গর্ভধারণ করেছিলেন। আল্লাহর কুদরতে ফিরআউনের লোকেরা তা বুঝতেই পারে নি। তাঁর জন্ম হলো। মা ফিরআউনের ভয়ে শিশু মূসাকে একটি সিন্ধুকে ভরে আল্লাহর নির্দেশে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। আল্লাহর কুদরতে সিন্ধুকটি ভাসতে ভাসতে নদীর তীরবর্তী ফিরআউনের রাজপ্রাসাদের ঘাটে গিয়ে ভিড়লো। ফুটফুটে মায়াভরা চেহারার শিশুটিকে দেখে ফিরআউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া কোলে তুলে নিলেন। আছিয়া ছিলেন ইসরাইলি কন্যা। তিনি এক আল্লাহতে বিশ্বাস করতেন। ফিরআউন তাঁকে জোর করে বিয়ে করেছিল। শিশু মূসা (আ) অন্য কারও দুধ পান না করায় হযরত মূসা (আ)-এর বড়বোন মরিয়মের পরামর্শে মূসা (আ)-এর মাকেই ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতে মূসা (আ) ফিরআউনের ঘরে, তারই অর্থব্যয়ে মায়ের কোলে লালিত পালিত হতে লাগলেন ।
মাদইয়ান বা মাদয়ান গমন
একবার মূসা (আ) দেখতে পেলেন কিবতী বংশীয় ফিরআউনের এক বাবুর্চি এক ইসরাইলী কাঠুরিয়ার প্রতি অত্যাচার করছে। তিনি ইসরাইলিকে বাঁচাবার জন্য কিবতীকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে সে মারা যায়। পরের দিনও অনুরূপ ঘটনা ঘটল। আর এক কিবতী আগের দিনের ইসরাইলির উপর অত্যাচার করছিল। মূসা (আ) এগিয়ে গেলে ইসরাইলী ভয় পেয়ে পূর্বদিনের ঘটনা বলে দেয়। কিবতী এসে ফিরআউনকে খবর দিল যে, কিবতীর হত্যাকারী মূসা (আ)। ফিরআউন মূসা (আ)-এর দণ্ড ঘোষণা করল । এ ঘটনা জানতে পেয়ে মূসা (আ) মিশর ছেড়ে লোহিত সাগরের পূর্বতীরে মাদয়ান চলে যান। সেখানে তিনি বিখ্যাত নবি হযরত শুআইব (আ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। হযরত শুআইব (আ) মূসা (আ)-এর খেদমত,কর্মদক্ষতা ও চারিত্রিক গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন। সেখানে তিনি দশ বছর কাটান। এ সময় তিনি বকরিও চরিয়েছেন।
নবুয়ত লাভ
হযরত মূসা (আ) স্ত্রী সফুরা এবং খাদেম ও মেষ-বকরি পাল নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মাদইয়ান থেকে মিশর যাত্রা করলেন। পথে আগুনের খুব প্রয়োজন ছিল। দূর থেকে আলো দেখে তিনি আগুনের খোঁজে তুর পাহাড়ের কাছে গেলেন। তিনি পাহাড়ের পাদদেশে ‘তুয়া’ নামক পবিত্র উপত্যকায় নবুয়ত লাভ করেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব যা আদেশ করা হয় তা শুনতে থাক।”- সূরা ত্বাহা: ১৩
এ সময় আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ)-এর সাথে সরাসরি কথা বলেছিলেন। এজন্য তিনি ‘কালিমুল্লাহ' উপাধিতে ভূষিত হন।
আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসাকে (আ) ফিরআউনের নিকট গিয়ে দীনের দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। হযরত মূসা (আ) আল্লাহর কাছে তাঁর দুর্বলতা ও অসুবিধার কথা জানিয়ে দোয়া করলেন। তিনি যেন তাঁকে সাহস দেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাজ সহজ করে দেন এবং তার মুখের জড়তা দূর করে দেন। যাতে লোকেরা তাঁর কথা বুঝতে পারে। তিনি তাঁর ভাই হারুন(আ) কেও সহযোগী হিসাবে চাইলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন।
হযরত মূসা (আ) তাঁর ভাই হারুন (আ) কে নিয়ে ফিরআউনের কাছে গিয়ে দীনের দাওয়াত দিলেন। তিনি আল্লাহর দেওয়া অলৌকিক ঘটনাও দেখালেন। কিন্তু ফিরআউন কিছুতেই ইমান আনল না। বরং সে হযরত মূসা (আ) কে হত্যা করার সংকল্প করল।
দলবলসহ ফিরআউনের ধ্বংস
হযরত মূসা (আ) ফিরআউনের কুমতলব জানতে পেরে ইসরাইলিদের নিয়ে মিশর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। সংবাদ পেয়ে ফিরআউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করল। মূসা (আ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নীলনদের তীরে উপস্থিত হলেন । সামনে নীলনদ ও পেছনে ফিরআউন বাহিনী।
এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার আদেশে হযরত মূসা (আ) হাতের লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত করলেন। পানি দুই ধারে সরে গেল। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি রাস্তা হয়ে গেল। হযরত মূসা (আ) তাঁর লোকজনসহ নিরাপদে নদী পার হয়ে গেলেন। ফিরআউন নদীতে শুকনা রাস্তা দেখে সে রাস্তা ধরেই পার হতে লাগল । যেই না তারা নদীর মাঝখানে পৌছল, অমনি রাস্তা নদীর পানিতে মিলিয়ে গেল। ফিরআউন তার দলবলসহ ডুবে মরল । আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেই সদলবলে ধ্বংস হলো।
হযরত মূসা (আ)-এর তাওরাত লাভ
হযরত মূসা (আ) আল্লাহর নির্দেশে তাওরাত কিতাব আনার জন্য তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে তিনি ইবাদতে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে সামেরী নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে অনুসারীদের অনেকেই গো-বৎস পূজায় জড়িয়ে পড়ল। হযরত মূসা (আ) তাওরাত নিয়ে ফিরে এসে এ অবস্থা দেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তওবা হিসাবে গো-বৎস পূজারিদের হত্যার নির্দেশ হলো। এতে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হলো। হযরত মূসা (আ) ও হযরত হারুন (আ)-এর কান্নাকাটিতে অবশিষ্টদের ক্ষমা করা হলো। হযরত মূসা (আ) ১২০ বছর জীবিত ছিলেন।
হযরত হূদ (আ) একজন নবি ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘আদ’ জাতির হিদায়েতের জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। ‘আদ’ সম্প্রদায় এবং হূদ (আ)-এর বংশতালিকা চতুর্থ পুরুষে ‘সাম’ পর্যন্ত পৌঁছে মিলে যায়। তাই হূদ (আ) তাদের বংশগত ভাই। আম্মান থেকে শুরু করে হাযরামাওত ও ইয়েমেন পর্যন্ত ‘আদজাতির বসতি ছিল। তারা যেমন ছিল শক্তিশালী তেমনি বিরাটাকায় সুঠামদেহের অধিকারী ছিল। তারা অহংকারী ও অত্যাচারী ছিল।
আদজাতি এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মূর্তিপূজা ও নানারকম শিরকে লিপ্ত ছিল। হযরত হূদ (আ) তাদের শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। জুলুম-অত্যাচার ত্যাগ করে ন্যায়নীতি ও সুবিচার করতে বলেন। তারা অহংকার করে আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ অমান্য করল। হযরত হূদ (আ) তাদের আজাবের ভয় দেখান, কিন্তু তারা ভয় পেল না। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রথমে অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষ এলো। এতেও তারা শোধরাল না। পরে তাদের উপর লাগাতার ৭ রাত ও ৮ দিন ভীষণ ঘূর্ণিঝড় চলল। এতে তাদের ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, গাছপালা ও লোকজন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। গোটা এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হলো। অহংকার তাদের পতনের কারণ হলো। আজাবের সময় হযরত হূদ (আ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে একটি কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের কিছুই হলো না। আল্লাহ তাঁদের নিরাপদে রাখলেন। পরে তাঁরা মক্কায় চলে যান ৷
হাজার হাজার বছর আগে এ পৃথিবীতে ‘সামুদ' নামে একটি জাতি বাস করত। এরা ছিল নূহ (আ)-এর পুত্র ‘সাম’-এর বংশধর। এ জাতি আরবের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বাস করত। এদের প্রধান শহর ছিল ‘হিজর’। বর্তমানে এটি মাদায়েনে সালিহ নামে পরিচিত।
আমরা আগেই জেনেছি এদের পূর্বে এখানে শক্তিশালী ‘আদজাতি’ বসবাস করত। তাদের হিদায়াতের জন্য তাদের কাছে হযরত হূদকে (আ) পাঠানো হয়েছিল। আল্লাহর অবাধ্যতার জন্য তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল।
সামুদজাতি ‘আদজাতির' রেখে যাওয়া ধন-সম্পদ হস্তগত করল। তারাও অর্থে-বিত্তে, শক্তিতে, বুদ্ধিতে সমৃদ্ধির অধিকারী হলো। এই জাতিও সম্পদ ও শক্তির অহংকারে আল্লাহকে ভুলে গেল ।
আল্লাহ তায়ালা তাদের হিদায়াতের জন্য তাদেরই বংশের লোক হযরত সালিহ (আ)-কে তাদের কাছে পাঠালেন। তিনি ‘সামুদ’ জাতিকে এক আল্লাহর উপর ইমান আনতে বললেন, তাঁর ইবাদত করতে বললেন। তারা আল্লাহর নবির কথা মানল না। তিনি তাদের আল্লাহর আজাবের সংবাদ দিলেন। তাতেও তারা ভয় পেল না। সালিহ (আ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ‘হিজর’ ত্যাগ করলেন। সামুদ জাতির উপর আল্লাহর আজাব এল । ভীষণ শব্দ ও ভূমিকম্পে তারা ধ্বংস হয়ে গেল ৷
হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন প্রসিদ্ধ নবি হযরত ইবরাহীম (আ) এর দ্বিতীয় পুত্র। তিনি হযরত ইসমাঈল (আ)-এর ছোট ভাই। তাঁর মায়ের নাম হযরত সারা (আ)। বিখ্যাত নবি ইয়াকুব (আ) ছিলেন তাঁর পুত্র। তাঁর বংশে অনেক নবি-রাসুল জন্মগ্রহণ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা হযরত লূত (আ)-এর নাফরমান সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্য ফেরেশতাদের পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁরা পথে ইবরাহীম (আ)-এর মেহমান হলেন। ইবরাহীম (আ) যথারীতি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু মেহমানদের আহারের ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখে বিস্মিত হলেন। মেহমানরা বললেন,“আমরা আল্লাহর ফেরেশতা। আমরা লূত (আ)-এর পাপী সম্প্রদায়কে ধ্বংসের জন্য সামুদ যাচ্ছি।” তাঁরা এ সময় ইবরাহীম (আ) ও তাঁর স্ত্রী সারা (আ) কে তাঁদের পুত্র ইসহাক (আ) এর জন্ম এবং নবি হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
ইসহাক (আ) তাঁর পিতা ইবরাহীম (আ) ও ভাই ইসমাঈল (আ)-এর দীন প্রচার করতেন। তিনি বেশিরভাগ সময় ছিলেন শামের ফিলিস্তিনে ।
তিনি ৪০ বছর বয়সে বিয়ে করেন। ৬০ বছর বয়সে তাঁর জময দুই সন্তান ঈসু ও ইয়াকুব (আ) জন্মগ্রহণ করে। তিনি ১৮৬ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
হযরত লূত (আ) একজন নবি ছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ভাই হারানের পুত্র। ছোটবেলাতেই লূত (আ)-এর পিতা হারান মারা যান। তাই ইবরাহীম (আ) ভাইয়ের ইয়াতীম ছেলেকে নিজের পুত্রের মতোই লালনপালন করতেন এবং নিজের সঙ্গে রাখতেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ইবরাহীম (আ)-এর সন্তান ছিল না। তিনি লূত (আ)কে নিজের ওয়ারিস মনে করতেন। ইবরাহীম (আ)-এর উপর প্রথম ইমান এনেছিলেন হযরত সারা (আ) ও হযরত লূত (আ)। তিনি ইবরাহীম (আ)-এর সাথে হিজরতও করেছিলেন।
হযরত ইবরাহীম (আ) যখন কিনআনে ছিলেন তখন তিনি লূত (আ)-কে সত্য দীন প্রচারের জন্য পূর্ব জর্দানের ‘সাদুম’ ও আমুরায় পাঠিয়েছিলেন। আরব, ফিলিস্তিন ও শামের মানচিত্রে দৃষ্টিপাত করলে বর্তমান পূর্ব জর্দান ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি বিখ্যাত ও বিশাল জলাশয় দেখা যায়। তাকে বলা হয় মৃতসাগর। তাকে লূত সাগরও বলা হয় ।
সাদুম ছিল অত্যন্ত উর্বর ও সবুজ-সজীব এলাকা। সেখানেই তিনি বসতি নির্মাণ করেন। সেখানকার লোকেরা অতি বিলাসী জীবনযাপন করত । তারা পাপ, লজ্জাহীনতা ও নাফরমানির কাজগুলো গর্বের সাথে প্রকাশ্যে করে বেড়াত ।
লূত (আ) তাদের হিদায়াতের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনো ফল হলো না। তারা লূত (আ) ও তাঁর অনুসারীদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিল। লূত (আ) তাদের বোঝালেন এবং আল্লাহর আজাবের কথা শোনালেন। কিন্তু তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতেলাগল। লূত (আ) আল্লাহর আদেশে অনুসারীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। কিন্তু তাঁর কাফির স্ত্রী রয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা আজাবস্বরূপ বিকট শব্দ ও পাথরবৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং এলাকাটিকে উল্টিয়ে দিলেন। এতে মৃতসাগর সৃষ্টি হয়। সাদুমবাসীর আজাবের নিদর্শন এখনও বিদ্যমান ।
হযরত শুয়াইব (আ) একজন বিখ্যাত নবি। তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)- এর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার পুত্র মাদয়ানের বংশধর। হযরত লূত (আ) -এর সাথেও তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। যে স্থানে তাঁরা বাস করতেন তাও মাদয়ান নামে অভিহিত। অতএব,মাদয়ান একটি জাতির ও একটি শহরের নাম। এটি ফিলিস্তিনের দক্ষিণ-পশ্চিম ও মায়নার পূর্বে মহাসড়কে অবস্থিত ছিল, যেখান থেকে শাম, আরব ও মিশরে বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করত। এলাকাটি অত্যন্ত উর্বর ও সমৃদ্ধশালী ছিল। বাসিন্দারা অত্যন্ত ধনী ছিল। মাদয়ান শহরটি আজও পূর্ব-জর্দানের সামুদ্রিক বন্দর ‘মায়ানের’ অদূরে বিদ্যমান আছে।
হযরত মূসা (আ) মিশর থেকে মাদয়ানে এসেছিলেন এবং হযরত শুয়াইব (আ)-এর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মূসা (আ) শুয়াইব (আ)-এর কন্যা সফুরাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি শুয়াইব (আ)-এর আশ্রয়ে ১০ বছর ছিলেন। শুয়াইব (আ)কে তাঁর চমৎকার বক্তৃতার জন্য খতিবুল আম্বিয়া বলা হয় ৷
হযরত শুয়াইব (আ)-কে যে সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে আহলে মাদয়ান, আসহাবে মাদয়ান ও আসহাবে আইকা বলা হয়। এরা মূর্তিপূজা করত । নিজেরা নবির কথা মানত না। যারা মানত তাদের বাধা দিত ও নির্যাতন করত । পথিকদের ধনসম্পদ লুটে নিত। মাপে-ওজনে কম দিত।
মাদয়ানবাসীদের বিকট শব্দ, অগ্নিবৃষ্টি ও ভূমিকম্প দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়া হয় ।
এরপর শুয়াইব (আ) হাযরামাওত যান এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন।
হযরত ইলিয়াস (আ) ছিলেন মূসা (আ)-এর ভাই হারুন (আ)-এর বংশধর। তিনি জর্দানের ‘আলআদ’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তখনকার ইসরাইলের শাসনকর্তা ছিলেন আখিব অথবা আখিয়াব। তিনি হযরত হিযকীল (আ)-এর পরে এবং আল ইয়াসা (আ)-এর পূর্বে বনি ইসরাইলের হিদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি হযরত হিযকীল (আ)- এর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শামের বাসিন্দাদের হিদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রচারের কেন্দ্র ছিল শামের শহর ‘বালাবাক্কু'।
ঐ সময় ইসরাইলিরা আল্লাহকে ভুলে যায়। তারা এক আল্লাহর ইবাদত না করে নানারকম শিরকে লিপ্ত হয়। তারা মূর্তি ও তারকা পূজা করত । তাদের প্রধান মূর্তি ছিল বা‘ল দেবতা। নবির কথায় বাদশাহ ইমান এনেছিল । কিন্তু তার স্ত্রীর প্ররোচনায় আবার শিরকে লিপ্ত হয়।
আল্লাহর আজাবে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল । ৩ বছর ধরে ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছিল । ঐ সম্প্রদায়ের লোকেরা নবির কাছে এসে আবেদন-নিবেদন করায় তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পর আবার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে মুশরিক হয়ে যায়। তাদের উপর আজাবের জন্য তারা নবিকেই দোষারোপ করে। তারা তাঁর প্রতি ঘোরতর শত্রুতা শুরু করে। তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাদের উপর আবার আল্লাহর আজাব আসে।
হযরত যুলকিফল (আ) ছিলেন আল্লাহ তায়ালার একজন প্রিয় বান্দা। যুলকিফল অর্থ প্রতিজ্ঞা রক্ষাকারী। দায়িত্ব পালনকারী। তিনি হযরত আইয়ুব (আ)-এর পুত্র ছিলেন বলে উল্লেখ আছে। নবি হযরত ইয়াসা (আ) খুব বৃদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাইলেন, যিনি তাঁর পক্ষ থেকে নবির কর্তব্য পালন করতে পারেন। নবি তার অনুসারীদের একত্রিত করে বললেন, যার মধ্যে তিনটি শর্ত বিদ্যমান থাকবে তাঁকেই আমি প্রতিনিধি নিযুক্ত করব। শর্ত তিনটি হলো
১. সর্বদা দিনে রোযা রাখা,
২. সারা রাত ইবাদত করা,
৩. কোনো সময় রাগ না করা।
এক ব্যক্তি উঠে বললেন, এ তিনটি গুণ আমার মধ্যে আছে। নবি প্রথম দিনের সমাবেশ শেষ করলেন। পরবর্তী দিনে আবার সমাবেশ হলো। নবি পূর্ববর্তী শর্ত আবার উল্লেখ করলেন। এবারও ঐ ব্যক্তি উঠে আগের মতো বললেন। নবি তাকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করলেন। হযরত যুলকিফল সারাজীবন শর্ত পূরণ করে চললেন।
ইবলিস শয়তান তাঁকে পথভ্রষ্ট করার জন্য এক মযলুম বৃদ্ধের বেশে পর পর তিন দিন তাঁর ধৈর্যচ্যুতির চেষ্টা করল । তাঁকে রাগাতে চাইল । কিন্তু পারল না। তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পরবর্তীতে নবি করেছিলেন।
হজরত যাকারিয়া (আ) ছিলেন বনি ইসরাইলের একজন নবি। তিনি ছিলেন হজরত সুলাইমান (আ)-এর বংশধর। তাঁর স্ত্রী ছিলেন হযরত হারুন (আ)-এর বংশধর। হযরত ঈসা (আ)-এর মাতা মরিয়মের অভিভাবক ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ) ৷ তিনি ইবাদতখানার ইমাম ও মোতোয়াল্লী ছিলেন। তাঁর বংশে হযরত ইমরান ও তাঁর স্ত্রী হান্না ছিলেন আল্লাহভক্ত । হান্না ছিলেন মরিয়মের মাতা ।
হযরত যাকারিয়ার কোনো সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ অবস্থায় সন্তানের আশাও ছিল না। মরিয়মের কাছে অমৌসুমি ফল দেখে তাঁর মনে আশার সঞ্চার হয়। তিনি আল্লাহর কাছে সন্তান কামনা করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলেন যার নাম হবে ইয়াহিয়া । তাঁর সম্প্রদায় তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না। ইমান আনল না। তারা নবির সাথে শত্রুতা শুরু করল। তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে লাগল । তিনি একটি গাছের কোটরে আশ্রয় নিলেন। ইহুদিরা তাকে গাছসহ দ্বিখণ্ডিত করল । তিনি উহ্ শব্দটিও করলেন না। সবুর করলেন। আমরা তাঁর জীবন থেকে ধৈর্যের শিক্ষা গ্রহণ করব ।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা দশজন নবি-রাসুলের নাম খাতায় লিখবে। |
হামদে ইলাহী
কাজী নজরুল ইসলাম
শোন শোন ইয়া ইলাহী
আমার মোনাজাত ।
তোমারি নাম জপে যেন
হৃদয় দিবস রাত।
যেন কানে শুনি সদা
তোমারি কালাম হে খোদা,
চোখে যেন দেখি শুধু
কুরআনের আয়াত
দুখে যেন জপি আমি
কলমা তোমার দিবস-যামী,
(তোমার ) মসজিদেরই ঝাড়ু বর্দার
হোক আমার এ হাত।
সুখে তুমি দুখে তুমি,
চোখে তুমি বুকে তুমি,
এই পিয়াসী প্রাণের,
খোদা তুমি আব হায়াত।